নাটিকা - মঈন উদ্দিন কোহেল
মুক্তির আলোয়
দৃশ্য : এক (সময় : সকাল। মাইকে দেশাত্ববোধক গান বাজছে। বাচ্চাদের
কোলাহল।)
বৃষ্টি : স্নেহা, এই স্নেহা।
স্নেহা : আরে বৃষ্টি, তোকে না গানের মহড়ায় দেখে এলাম। মহড়া
কি শেষ ?
বৃষ্টি : না। একটু বিরতি দিয়েছে। কিছুক্ষণ পর নাটকের মহড়া শুরু
হবে। সুমি আপু বললো, আমাদেরকে কাছাকাছি কোথাও থাকতে। তুইওতো নাটকে আছিস, তাই না ?
স্নেহা : হ্যাঁ। আচ্ছা নাটকের সংলাপ মুখস্ত হয়েছে তোর ?
বৃষ্টি : হ্যাঁ হয়েছে। তোর ?
স্নেহা : আমারও। তবে কিছুটা ভয় ভয় লাগছে, জানিনা ঠিক মতো পারবো
কিনা।
বৃষ্টি : আরে ভয় কিসের !
স্নেহা : তোরতো ভয় লাগার কথা না, তুইতো আগে স্কুলের অনেক নাটকে
অংশগ্রহণ করেছিস। কিন্তু আমিতো এবারই প্রথম অংশগ্রহণ করবো।
বৃষ্টি : আরে প্রথম প্রথম এরকম মনে হয়। যখন মঞ্চে একবার দাঁড়াবি,
তখন দেখবি ভয়-ডর কোথায় উড়ে গেছে।
স্নেহা : তাই যেন হয় রে।
(নিলয় ও সুমনের প্রবেশ)
নিলয় : বৃষ্টি, স্নেহা তোরা এখানে ?
বৃষ্টি : কেন, কি হয়েছে ?
নিলয় : সুমি আপু বললো, তোদেরকে ডেকে আমাদের ক্লাসরুমে অপেক্ষা
করতে। আপু কিছুক্ষনের মধ্যে আসবেন।
স্নেহা : আমরাতো এখানেই আছি।
সুমন : আজ ১৬ই ডিসেম্বর উপলক্ষে আমাদের স্কুলের কুচকাওয়াজটা
খুব ভালো হয়েছে তাই না ?
বৃষ্টি : হ্যাঁ।
স্নেহা : আমাদের ডিসপ্লেটাও খুব ভালো হয়েছে বললো সবাই।
নিলয় : এবার ভালোয় ভালোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা ভালো হলে
হয়।
সুমন : হবে, অবশ্যই ভালো হবে।
স্নেহা : কি করে বুঝলি ?
সুমন : আরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তোদের বস এই সুমন আছে না
! অনুষ্ঠান ভালো না হয়ে কি পারে !
বৃষ্টি : অ্যাঁ...কি আমাদের বসরে ! এখনো নাটকের ডায়ালগই ঠিকমতো
মুখস্ত করতে পারেনি, তিনি আবার আমাদের বস।
নিলয় : তোরা যাই বলিস, সুমন কিন্তু সত্যিই ভালো করবে।
স্নেহা : তা আমরা অস্বীকার করতে পারবো না। ও একটু পাগলা হলেও,
গুনি বটে !
সুমন : কি ! আমি পাগলা ! ঠিক আছে দেখাচ্ছি তোকে, পাগলামি
কাকে বলে।
নিলয় : আরে আরে ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন, ও না হয় একটু মজা করলো
আরকি।
বৃষ্টি : আচ্ছা বাদ দে, সুমি আপু আসার আগে আমরা নাটকের মহড়াটা
নিজেরা একবার করে নিই।
নিলয় : না থাক। তারচেয়ে এই ফাঁকে আমরা একটু আংতেকশরি খেলি,
কি বলিস ?
স্নেহা : হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। নিলয় আর সুমন একদলে, আমি
আর বৃষ্টি আরেক দলে।
সুমন : আমার একটা আইডিয়া এসেছে।
সকলে : কি ?
সুমন : আজতো ১৬ই ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস। আমরা আংতেকশরিতে
আজ শুধু দেশাত্ববোধক গানই গাইবো। ঠিক আছে ?
সকলে : ঠিক আছে।
নিলয় : তাহলে প্রথমে কারা গাইবে ?
সুমন : প্রথমে তোরা গা।
বৃষ্টি, স্নেহা : না না, তোরা
আগে।
নিলয়, সুমন : না না, তোরা।
বৃষ্টি, স্নেহা : না না, তোরা।
সুমন : আচ্ছা ঠিক আছে, আমরাই আগে গাইছি। কোনটা গাওয়া যায়
বলতো নিলয় ?
নিলয় : “ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা,
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী
সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে
পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রাণী সে যে
আমার জন্মভূমি ॥”
সুমন : ভূমি, মানে ‘ম’ দিয়ে গান।
বৃষ্টি, স্নেহা : “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা,
মাগো তোমার কোলে তোমার বোলে, কতই শান্তি
ভালোবাসা...”
বৃষ্টি : এবার তোরা গা ‘স’ দিয়ে।
সুমন : স দিয়ে...স দিয়ে...
বৃষ্টি, স্নেহা : এক, দুই,
তিন...
নিলয় : মনে পড়েছে, মনে পড়েছে...
“সোনা সোনা সোনা, লোকে বলে সোনা
সোনা নয় ততো খাঁটি
বলো যতো খাঁটি তার চেয়ে
খাঁটি,
বাংলাদেশের মাটিরে
আমার বাংলাদেশের মাটি
আমার জন্মভূমির মাটি ॥”
সুমন : এবার ‘ট’ দিয়ে।
বৃষ্টি : ট দিয়ে...ট দিয়ে কি গান আছে...
সুমন, নিলয় : এক, দুই, তিন,
চার, পাঁচ...
(সুমি আপুর প্রবেশ)
সুমি : আরে তোমরা এখানে, আমিতো তোমাদের পাশের রুমে বসতে বলেছিলাম।
কি ব্যাপার, অন্যরা কোথায় ? সুমন, তোমাকে না বলেছি, সবাইকে খুঁজে আনতে। আর তুমি কিনা
খেলায় মজে গেছো। আসলে তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না !
স্নেহা : আমরাও তাই বলছিলাম আপু।
সুমন : এই চুপ থাক ! আমি এক্ষুনি যাচ্ছি আপু।
সুমি : তোমাকে আর যেতে হবে না। আমি দাদুকে দিয়ে ডেকে পাঠাচ্ছি।
দাদু, দাদু, এই দাদু, আপনি একটু কষ্ট করে নাটকে যারা অংশগ্রহণ করছে তাদের এখানে পাঠিয়ে
দিনতো। এবার বলো, সংলাপ সবার মুখস্ত হয়েছেতো ?
সবাই : জি আপু।
সুমি : গুড। তোমারাতো জানো আজ ১৬ই ডিসেম্বর। এই ১৬ই ডিসেম্বর
আসলে কি ?
সকলে : আমাদের মহান বিজয় দিবস।
সুমি : হ্যাঁ, ১৬ই ডিসেম্বর আজকের এই দিনে আমরা মুক্তিযুদ্ধে
বিজয় অর্জন করেছিলাম। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর অবশেষে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন
দেশ, একটি স্বাধীন মানচিত্র, বাংলাদেশ। এই দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে আমরা হারিয়েছি অসংখ্য
বীর বাঙ্গালীকে, যাঁরা অস্ত্র হাতে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ভাই হারিয়েছে বোনকে,
বোন হারিয়েছে ভাইকে, পিতা হারিয়েছে সন্তানকে, সন্তান হারিয়েছে মা'কে। আজকের এই দিনে
আমরা সবাইকে জানাই স্বশ্রদ্ধ সালাম।
বৃষ্টি : আপু ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস তাই না ?
সুমি : হ্যাঁ, জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
আহবানে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে এবং দীর্ঘ
নয় মাস যুদ্ধ শেষে অবশেষে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মিত্র
বাহিনীর কাছে আত্বসমর্থন করতে বাধ্য হয়। আর আমরা পেয়ে যাই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
তাইতো আজকের এই দিনটাকে আমরা গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। তাইতো আজকে আমাদের এই সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান। আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে মহড়া শুরু করা যাক। বৃষ্টি আর স্নেহা মেয়েদের সংলাপ
বলবে, নিলয় আর সুমন ছেলেদের। আমি ফরিদার চরিত্র ধরছি। শুরু কর। ওয়ান, টু, থ্রি...
ছেলে : মা, তোমার সন্তানদের মনে আজ অনেক প্রশ্ন।
মেয়ে : সন্তানদের কাছে মা-ই হচ্ছেন প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষাদাতা।
ছেলে : তুমি ছাড়া আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবার আর কেউ নেই
মা।
মেয়ে : দ্বারে দ্বারে অনেক ঘুরেছি। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর
পাইনি।
ফরিদা : আমার সন্তান, আমার আঁচল।
সুমন : আমার দেশ তোমারই মতন আমার আরেক মা। আজ আমার দেশের
আকাশে এতো কালো মেঘের আনাগোনা কেন ? কেন আকাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রুদ্ধ শকুন ?
বৃষ্টি : বাংলার আকাশে তীব্র বারুদের গন্ধ। তোমার ঘামে ভেজা
আঁচলের গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে ঐ বারুদের গন্ধে।
নিলয় : অন্ধকারে ওঁৎ পেতে আছে নৃশংস নরঘাতক। তোমার সন্তানের
দেহে প্রবাহিত তোমারই রক্তকে কলুষিত করার দানবীয় উল্লাসে মত্ত এই ঘাতক। কেন মা ? কেন
?
স্নেহা : তুমিই আমাদের শেষ ভরসা। প্রশ্নের উত্তর দাও মা।
ফরিদা : “আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর
নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার
শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে,
এদেশ কি ভুলে গেছে সেই
দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
সুমন : জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন,
জাতির পতাকা আজ খামচে
ধরেছে সেই পুরোনো শকুন...
(গুলির শব্দ)
ফরিদা : কেউ নড়বে না একচুল। যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাক। আমার
সন্তান, আমার আঁচল। কাউকে ভয় করি না আমি। বল সবাই, আমার সন্তান...
সকলে : তোমার আঁচল...
ফরিদা : আমার সন্তান...
সকলে : তোমার আঁচল...
ফরিদা : আমার মুক্তি...
সকলে : আলোয় আলোয়...
(‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গান দিয়ে শেষ)
(সমাপ্ত)
Comments
Post a Comment