গল্প

চাঁদ ও ধ্রুবতারা

সৈয়দা শর্মিলী জাহান



আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিলো নতুন প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুলে। প্রথম চাকরী,তাই উত্তেজনা কাজ করছিলো। দুরু দুরু বুকে প্রধান শিক্ষিকার সাথে দেখা করতে গেলাম। তিনি জানালেন স্কুলটি নতুন, প্রতিষ্ঠিত স্কুলের থেকেও দ্বিগুণ শ্রম দিতে হবে এখানে। যেভাবেই হোক পুরাতন ছাত্র-ছাত্রী ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন ছাত্র-ছাত্রী যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে ।

আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল কে.জি শ্রেণীর শ্রেণী শিক্ষিকা । আমাকেই প্রতিদিন একটানা পাঁচটি ক্লাশ নিতে হবে, ত্রিশ মিনিট করে । প্রথমদিন ক্লাসে যাবার আগে প্রধান শিক্ষিকা আমায় ডেকে বললেন "শোন, তোমাকে যে শ্রেণীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটা এই প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে দুষ্ট বাচ্চাদের একটি শাখা, এবং এই শাখার অভিভাবকগুলোও একটু অন্যরকম ধরণের। দু'তিনজন আছেন পান থেকে চুন খসলেই অভিযোগ নিয়ে আসেন। কাজেই সাবধানে ক্লাস নেবে।"মনে মনে উপরওয়ালাকে স্মরণ করলাম,প্রথম চাকরি। কোন অভিজ্ঞতা নেই । উত্তরে শুধু এটুকু বললাম ।" ম্যাডাম, আমি চ্যালেঞ্জিং কাজ পছন্দ করি,কতটুকু পারবো জানিনা তবে সততার সাথে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। "

প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই দেখলাম বিশৃঙ্খল অবস্থা। একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি এলোমেলো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে যেন ক্লাসে । মুক্ত স্বাধীন । অর্থাৎ ক্লাশ শুরুর ঘন্টা তাদের কানে পৌঁছেনি । আমি কাঁধের ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদেরকে দেখছিলাম । যে পর্যন্ত নিজে নিজে শান্ত না হলো সে পর্যন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম । পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম এদের বৈশিষ্ট্য দিয়েই এদেরকে পথে আনতে হবে । একসময় নেতা গোছের একটি মেয়ে বলে উঠলো "এই সবাই চুপ চুপ । নতুন ম্যাডাম এসেছে ।"... বুঝলাম সেই ক্লাসের ক্যাপ্টেন । নাম লিমু।

ওদের সাথে প্রাথমিক পরিচিতি শেষে বললাম " তোমরা এখানে কেন এসেছো?" প্রশ্ন শুনে কচি কচি নিষ্পাপ মুখগুলোতে মুক্ত ঝরানো হাসির রোল পরে গেলো । 

"ম্যাডাম আপনি জানেন না? এখানে আমরা পড়তে এসেছি । হা হা হি হি হু হু হি হি হি । "
আমি বললাম " কিন্তু আমি ঠিক করেছি, তোমাদেরকে পড়াবো না । আমরা ছুটির আগ পর্যন্ত খেলাধূলা করে পার করে দিব ।" 

"ওমা নতুন ম্যাডাম একি বলে!" মুহূর্তেই ফিসফাস গুঞ্জনে মুখরিত ক্লাস । এমন কথা যেন কখনো কেউ শোনেনি! পড়তে এসেছি পড়বো না? বিস্ময়ের শেষ নেই ওদের । অবশেষে এক দুস্টু বলে উঠলো "ম্যালাম (ম্যাডাম) তাহলে বই খাতা সব বাইরে ফেলে দিয়ে আসি?

"ম্যাডাম! ও না ম্যাডাম বলতে পারে না হি হি হি!" আরেক দুস্টুর উত্তর। এমন সময় আরেকজন উঠে দাঁড়াল "ম্যাডাম আমি রাস্তা ঝাড়ু দিতে পারব না!" 
অপ্রাসংগিক কথা শুনে সেদিকে তাকালাম "কেন কি হয়েছে?

"ম্যাডাম আপনি বললেন পড়াবেন না, আর আমার বাবা বলেছে পড়ালেখা না করলে রাস্তা ঝাড়ুর কাজ করতে হবে ।" মনে মনে খুশি হলাম আস্তে আস্তে মূল প্রসঙ্গে আসছে বলে।

ইরাজ বললো " ম্যালাম(ম্যাডাম) আমার ইচ্ছা বড় হয়ে পুলিশ হব, চোর ধরব । পড়ালেখা না করলে কি চোরের নাম লিখতে পারব ?"
শিশির বললো " ম্যাডাম জেরিনের কি পড়তে হবে? ও বলেছে বড় হয়ে খালি সাজুগুজু করবে, সাজুগুজু করতে কি পড়তে হয়?"

জেরিনের উত্তর "কে বলেছে তোকে পড়তে হবে না? আমি সাজুগুজু করে বিজ্ঞাপন করব, সবাইকে অটোগ্রাফ দিতে হবে না?"

মিম " ম্যাডাম শিশিরকে তো পড়তে হবে, ও বলেছে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, ডাক্তার হয়ে শোয়েবের চিকিৎসা করবে, শোয়েব না ক্লাসে খালি হিসু করে দেয়, হি হি হি । " যথারীতি পুরো ক্লাসে আবার হাসির রোল।

রিসি " ঠিক ম্যাডাম, শোয়েব হিসু করে আমার বই খাতা ভিজিয়েছে ,ওর চিকিৎসা দরকার হি হি হি ।"
আমি খুব উপভোগ করছিলাম ওদের কথা । ওরাও যেন এক মুহূর্তেই আপন করে নিল আমায় । নিষ্পাপ মুখগুলোতে নির্ভয়ে বলা মজার কথাগুলো মনের সব উদ্বেগ দূর করে দিলো । বাচ্চাদের আমার এমনিতেই খুব পছন্দ,ওদের সাথে ভাব হতে বেশী সময় লাগে না। এবার দুষ্টুগুলো উল্টো আমার পরীক্ষা নিতে শুরু করলো। 

ইরাজ বলে উঠলো " ম্যালাম! আপনি ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত না দেখেই বলতে পারেন?..."

"হ্যাঁ পারি"... এরপর একে একে ওদের বইয়ের ছড়া, ইংরেজীতে বিভিন্ন ফুল-ফলের নাম, গনিতের যোগ-বিয়োগ নিয়ে আমায় প্রশ্ন করে চলল! সঠিক উত্তর পেয়ে অবাক হয়ে নিষ্পাপ প্রশ্ন " ম্যাডাম আপনি কি সব সময় ক্লাসে ফার্স্ট হতেন? কোনদিন পিট্টি খাননি তাই না?  কত্ত বুদ্ধি আপনার! সব পড়া মনে আছে ! সব পারেন!"
উত্তর দেব কি প্রশ্নটা শুনে হেসেছিলাম খুব। শিশুরাই পারে, না বুঝে আত্মবিশ্বাসের সাথে নির্দিধায় এমন মজার ভুল করতে ।

এভাবেই প্রথম দিনটি গল্প গুজব করে পার করে দিলাম, খুব একটা পড়ালাম না । প্রতি বিষয়েই অল্প কিছু কাজ দিয়ে ছুটি দিয়ে দিলাম । প্রথম দিনই আমার হৃদয় জয় করে নিলো শিশুগুলো ।
প্রথমদিন ক্লাস শেষ করে এসে প্রধান শিক্ষিকার সাথে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলেন " কি শর্মিলী? কেমন মনে হচ্ছে? পড়াতে পারবে তো ওদের? "

বললাম "ম্যাডাম বাচ্চাগুলো মেধাবী কিন্তু ওদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে । আমি আপনার কাছে একমাসের সময় চাচ্ছি, এই একমাস আমি ওদেরকে আপনার প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস অনুযায়ী কিন্তু আমার মত করে পড়াতে চাই, আমি কি সুযোগটি পেতে পারি?"  আরও বিস্তারিত আলোচনার পর শর্তসাপেক্ষে তিনি আমায় অনুমতি দিলেন । পরদিন থেকে শুরু হলো আমার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন ।

আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক মজা করতাম । ক্লাসে সব সময় বলতাম " সবসময় পড়া নিয়ে থাকবে না, খেলাধূলাও করতে হবে তবে পড়া শেষ করে।" ছোট ছোট বাচ্চারা এটি খুব পছন্দ করতো । ক্লাসের পড়া শেষ হলে ওদেরকে দিয়ে গান,কবিতা,অভিনয় করাতাম । ত্রিশ মিনিট করে পাঁচটি বিষয় নিতে হত প্রতিদিন, এর মধ্যে টিফিন বিরতি ছিল বিশ মিনিট ।

এরা কেউ খুব একটা লিখতে চাইত না, দু একজন বাদে বাকিদের হাতের লিখা ছিল খুবই খারাপ । তাই আমি মজা করে একদিন বললাম " কি রে? লিখা তো নয় যেন চানাচুর আর নুডুলস ছড়িয়ে রেখেছিস খাতায়, খেয়ে ফেলবো নাকি খাতা?" 

খুব মজা পেলো ওরা এ কথা শুনে । লিমু বলে উঠলো " ম্যাডাম, জেরীনের খাতা খেতে সবচেয়ে মজা হবে। একদম এক নম্বর চানাচুর । হি হি হি ।"এরপর ওরা নিজেরাই হাতের লিখা সুন্দর করার জন্য উঠেপরে লেগেছিল এবং সবার হাতের লিখা ধীরে ধীরে সুন্দর হয়েছিলো ।

দুষ্টামি করলে শাস্তির নাম দিয়েছিলাম চমচম (আস্তে করে মারতাম),আর কানের নাম দিয়েছিলাম চন্দ্রবিন্দু! দুষ্টামি করে ওরা বলতো " ম্যাডাম পড়া না পারলে কি চন্দ্রবিন্দু মলে দেবেন?" শাস্তি বলতে এ দুটোই দিতাম। এগুলো ওদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলো । প্রয়োজনে শাসনও করেছি না মেরে, মাথায় তুলিনি । ফলে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দুটোই ছিল।

অভিভাবকদের সাথেও ব্যাক্তিগতভাবে যোগাযোগ রাখতাম । বাচ্চাগুলো বাসায় ঠিকমতো পড়ছে কি না? আমার পড়াগুলো বুঝতে পারছে কি না? খোঁজ খবর রাখতাম । অভিভাবকদের বক্তব্য ছিলো " ম্যাডাম আপনি ক্লাস নেবার পর থেকে পড়ার কথা ওদেরকে বলতে হয় না । ওরা নিজে থেকেই আনন্দের সাথে সব পড়া আর বাড়ীর কাজগুলো করে ফেলে । আগামীকাল আপনাকে দেখাবে বলে ।" আমি খারাপ-ভালো সব ছাত্র-ছাত্রীকে সমান গুরুত্ব দিতাম এবং ভালোবাসতাম। 

কোনকিছু লিখতে দিলে হাতের লিখা তাড়াতাড়ি শেষ করে, আমার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গল্প করা ছিল ওদের প্রিয় কাজ । একদিন ইরাজ এসে বলল "ম্যালাম আপনি কি নামাজ পড়েন?
অবাক হয়ে বললাম "হ্যাঁ, পড়ি তো। কেন? " ম্যালাম আমি তো মসজিদে প্রতিদিন বাবার সাথে নামাজ পড়তে যাই, কিন্তু আপনাকে কোনোদিন মসজিদে দেখি না কেন? ...প্রশ্ন শুনে না হেসে পারলাম না ।
একদিনের কথা মনে পড়ে খুব । ক্লাসে ঢোকার পর পরই ওরা বলে উঠলো " ম্যাডাম , আপনাকে আমরা প্রধানমন্ত্রী বানাবো । " 
 " সে কি ! কিভাবে?" 
 " ম্যাডাম ,  এরপরের ইলেকশানে আপনি দাঁড়াবেন,তাহলেই হবে । "
 " ওমা, আমাকে কে ভোট দেবে?" 
 " ম্যাডাম , আমরা সবাই আপনাকে ভোট দেব । তারপর প্রধানমন্ত্রী হয়ে আপনি আমাদের জন্য শিশুপার্ক বানাবেন । তারপর আমরা সবাই ওখানে খেলবো ।"
 খুব মজা পেলাম ওদের ভাবনা জেনে । ভাবলাম কত সহজ, সুন্দর, রঙিন আর নির্ভেজাল ওদের পৃথিবী । 
 ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে স্কুল ছুটির আগে চার-পাঁচজন একসাথে এসে চুপ করে টেবিলের সামনে দাঁড়ালো । আমি খাতা দেখছিলাম । মুখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই এক টুকরো কাগজ দিলো আমার হাতে । সেখানে কচি হাতে লেখা " ম্যাডাম ঈদের দিন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন "। সেটাই ছিলো আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দাওয়াত! আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরে সজল চোখে আদর করে দিলাম সবগুলোকে ।
হঠাৎ একদিন নাদিয়ার জিজ্ঞাসা ছিল "ম্যাডাম আপনার কি বিয়ে হয়েছে? শাড়ি পরেন না কেন ম্যাডাম? সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের সবার দাবি ম্যাডাম কাল শাড়ি পরবেন । আপনাকে সুন্দর লাগবে এবং রঙও পছন্দ করে দিল "লাল" । আমি শাড়ি পরতে ভালোবাসিনা  ; তবু ওদের আবদার রাখতে একটি লাল শাড়ি কিনেছিলাম।

ওদের সাথে শত শত মায়া মাখানো স্মৃতি ঝুলিতে জমা হতে লাগলো আমার । বছরের একদম শেষে  ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি হয়ে গেলো আমার। বিদায় আসন্ন । জীবনের বাস্তবতা যে খুব কঠিন ; সেখানে আবেগের মূল্য নেই! স্বর্গীয় নিষ্পাপ ভালোবাসার যে বাঁধনে আমি জড়িয়ে ছিলাম তা আমায় ছিন্ন করতে হবে। অজান্তেই বুকের ভেতর বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো । 

ভেবে রেখেছিলাম আমার স্মৃতি হিসেবে শেষ ক্লাসে বিদায়ের আগে সবাইকে একটি করে বই উপহার দেব । সবার পছন্দ অনুযায়ী বই কিনে তাতে একটি লাইন লিখে দিলাম " আজীবন সৎ থেকো--নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি এবং দায়িত্বের প্রতি"।

ওদের প্রিয় লাল রঙের শাড়ী পরেছিলাম । ওদের বাড়িয়ে দেয়া কচি ছোট ছোট হাতের দু'মুঠো ভরে দিয়েছিলাম চকোলেটে। খুশিতে চকচক করছিল ওদের মুখ। ওদের ম্যাডাম কথা রেখেছে লাল শাড়ি পরেছে! 

ক্লাশ শেষে বিদায় বলতে পারিনি কিছুতেই! প্রতিটি মুখ আমার আকাশে চাঁদ ও ধ্রুবতারা হয়ে আজও জ্বলছে। একেকটি চাঁদ, তারায় অনেক আলো। তবু চোখ ধাঁধিয়ে যায় না । অদ্ভুত এক পবিত্র আলো ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের গভীর থেকে গভীরে ।  

শূন্যতায় শুধু একটি শব্দের প্রতিধ্বনি " ম্যাডাম! ম্যাডাম! ও ম্যাডাম!"

Comments

  1. গল্পটা স্পর্শ করে গেল কোথাও। নিজেও শিক্ষকতা করি বলে বোধহয় আরো বেশী ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগলো রুমি। আরো লিখো

    ReplyDelete
  3. অনবদ্য লেখনি। ঘটনা মজার।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা