পুরোনো যুগের কথা
সময়টা সম্ভবত ১৯৬০ সালের অক্টোবর মাস। ৩০ বা ৩১ তারিখ হবে। আকাশ খুব মেঘলা ছিল সেদিন। সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। এরই মধ্যে দুপুরবেলা বড় আপার শ্বশুরবাড়ি ধলঘাট থেকে খবর এলো- বড় আপার বাচ্চা হবে। জরুরী ভিত্তিতে মাকে যেতে হবে ওখানে। যে লোক খবর নিয়ে এসেছে তার সাথেই যেতে হবে। বাবা তখন চাকরীসুত্রে ঢাকায় ছিল। খবর দেবার উপায় নেই। গোমদণ্ডী থেকে ধলঘাট যাওয়ার জন্য ট্রেনই সবচেয়ে দ্রুততম উপায়। দুপুরে কোনমতে খেয়ে মা তৈরী হয়ে নিল। সাথে আমি ও আমার ছোটভাই যাবো। আমাদের দুজনের বয়সই তখন দশ বছরের কম। আমাদের দুজনকে নিয়ে মা সেই লোকটার সাথে রওনা দিল গোমদণ্ডী স্টেশনের দিকে।
শহর থেকে যে ট্রেন দোহাজারি যাবে সেই ট্রেনেই যেতে হবে আমাদেরকে। বৃষ্টির মধ্যে ট্রেন আসলো। আমরা উঠে পড়লাম। ট্রেনে ওঠার পর বৃষ্টি আরো বেড়ে গেল। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। সেই সাথে বাতাস। বাতাসের তাণ্ডবে ট্রেনের ভেতরে পর্যন্ত ভিজে যাচ্ছে যাত্রীরা।
ট্রেন যখন ধলঘাট স্টেশনে পৌঁছালো তখনো প্রচণ্ড ঝড়বাদল চলছে। তারই মধ্যে আমরা তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নিলাম। ধলঘাট স্টেশন থেকে আপার শ্বশুরবাড়ি প্রায় এক মাইল পথ। পুরোটা রাস্তা হেঁটে যেতে হয়। অন্য কোন ব্যবস্থা নেই। সোজা রেললাইন বেয়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু এই ঝড়বাদলের মধ্যে এতটা পথ কিভাবে হাঁটবো। সেজন্য স্টেশনে বসে থাকলাম সবাই। আরো যাত্রীরা আছে। সবাই জুবুথুবু হয়ে স্টেশনের নানান কোণে আশ্রয় নিয়েছে। কখন বৃষ্টি কমবে তারপর যাত্রা করবে সবাই।
বিকেল হয়ে এসেছে ততক্ষণে। কিন্তু চারদিকে এতই মেঘলা অন্ধকার মনে হচ্ছিল সন্ধ্যা নেমে গেছে। তখনো কারেন্টের যুগ আসেনি। স্টেশন মাস্টারের রুমের ভেতর একটা হারিক্যান জ্বলছিল টিমটিম করে। রাত হয়ে গেলে অন্ধকারে কিভাবে হাঁটবো সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সবাই। এর মধ্যে বৃষ্টি একটু কমে আসলে আমরা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। রেললাইন ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। যতটা দ্রুত সম্ভব পা চালাচ্ছি। কিন্তু অল্প কিছুদূর না যেতেই আবারো বৃষ্টি নামলো। সেই সাথে ঝড়ো বাতাস। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। সামনে একটা ব্রিজ পার হলেই বড় আপার শ্বশুরবাড়ি। ব্রিজের গোড়াতে পৌঁছার পর ঝড়ো হাওয়া যেন চুড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছালো।
ব্রিজটা কেমন সেটা একটু বোঝাতে হবে। রেলব্রিজগুলিতে কোন রেলিং থাকে না। শুধু রেল লাইন আর কাঠের তক্তা। কাঠের তক্তার উপর দিয়ে পা রেখে ব্রিজ পার হয় সবাই। নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গভীর খাল। তক্তা দুটোর মাঝে দেড় ফুটের মতো ফাঁক। নীচে তাকালে মাথা ঘুরে ওঠে। স্বাভাবিক সময়েই এটা পার হওয়া ছোটদের জন্য কঠিন। এখন ভয়ংকর এই ঝড়ের মধ্যে আমাদের ব্রিজটা পার হতে হবে।
চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। এদিকে কোথাও আশ্রয় নেবার জায়গা নেই। প্রথমে আমাদের নিতে আসা সেই লোকটা পার হয়ে গেছে কোনমতে। তারপর মা আর আমরা দুই ভাইবোন পার হতে শুরু করেছি। ঝড় যেভাবে বাড়ছে তাতে আমাদের উড়িয়ে নেবার মতো অবস্থা।
শোঁ শোঁ ঝড়ের গর্জনের সাথে যে বৃষ্টি পড়ছে সেখানে কখনো গরম ফোটাও পড়ছে। বুঝতে পারছিলাম না বৃষ্টির পানি কিভাবে গরম হয়। আসলে ঝড়ের কেন্দ্রে কখনো কখনো এরকম হয়। বাতাস গরম হয়ে যায়। হেঁটে পার হবার উপায় নেই। মা দুজনকে দুহাতে ধরে রেখেছে। আমরা চিৎকার দিয়ে কাঁদতেও চাইছিলাম। কিন্তু কে শুনবে এখানে।
কয়েক পা আগানোর পর আর পারলাম না। বাতাসের তোড়ে উড়ে যাচ্ছি প্রায়। ব্রিজের তক্তা ধরে তিনজনই বসে পড়লাম। বসে থাকলে তো চলবে না। পেছনে যাবার উপায় নেই। সামনেই যেতে হবে। হামাগুড়ি দিয়ে একেকটা তক্তা পার হচ্ছি। প্রবল বাতাসের শব্দে কানে তালা লেগে গেছে। ঝড়ো হাওয়া যে কোন সময় আমাদের উড়িয়ে নিয়ে খালের পানিতে ফেলে দিতে পারে।
অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে একেকটা তক্তা ধরে ধরে আমরা কতক্ষণে যে ব্রিজটা পার হলাম জানি না। কিন্তু পার হবার পর মনে হলো নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি। মনে হয় এবারের মতো বেঁচে গেলাম ভয়ংকর একটা অবস্থা থেকে।
ব্রিজ পার হয়েই কয়েকশো গজ দূরেই বাড়ি। কিন্তু ঝড়ের তাণ্ডবে গাছপালা পড়ে সেই পথটা বন্ধ হয়ে আছে। ব্রিজ পার হলেই একটা ওখানে চায়ের দোকান ছিল, দোকানের ঝাঁপ ফেলে দেয়া হয়েছে। আমরা ডাক দিলে ঝাঁপ খুললো একটু। আমরা দ্রুত সেখানে ঢুকে পড়লাম। ঝড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের শরীর শীতে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ানক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। দোকানদার আমাদের পরিচয় পেয়ে ভেতরে নিয়ে গা মাথা মোছার জন্য গামছা দিলেন। আমাদেরকে গরম চা বানিয়ে দিলেন।
আমরা ঝড় না থামা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। ঝড় একটু থামলে আমরা পেছনের পুকুর পাড় দিয়ে সরু পায়ে হাটার পথ দিয়ে বাড়িতে যাবার জন্য বের হলাম। কিন্তু ওদিকেও অনেক গাছ পড়ে পথ বন্ধ। তখন চা দোকানী আমাদের হাতে একটা দা দিলেন। ডালপালা কেটে কেটে যেন আমরা বাড়ি পৌঁছাতে পারি।
তারপর বহু কষ্টে পড়ে থাকা গাছপালার জঙ্গল কেটে কেটে বাড়ির উঠোনে গিয়ে যখন ডাক দিলাম তখন সবাই ছুটে এসে আমাদেরকে ভেতরে নিয়ে গেল। ওরা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি আমরা এই ঝড়বাদল মাথায় নিয়ে চলে আসবো। সাথে থাকা লোকটাকে সবাই বকা দিচ্ছিল আমাদেরকে এরকম বিপদ মাথায় করে আনার জন্য। স্টেশন মাস্টারের বাসা আছে ধলঘাট স্টেশনের পেছনে। ওখানে বড় আপাদের কথা বললে ওরা আমাদের যত্ন করে রাখতো। কিন্তু বোকা লোকটার সেটা মাথায় ছিল না। তাই আমাদেরকে ঝড় বাদল মাথায় করে নিয়ে এসেছিল।
পরে জেনেছি সেই ঝড়টা ছিল বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানা শক্তিশালী একটা ঘুর্ণিঝড়। লাখ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই ঝড়ে। তখন তো রেডিও টেলিভিশন ছিল না। সিগন্যাল দেবার সিস্টেমও উন্নত ছিল না বলে আমরা কেউ আগ থেকে জানতাম না কী ভয়ানক বিপদ আসছে। সেই ভয়ংকর ঝড়ের রাতের কথা ভাবলে এখনো শিউরে উঠি।
[অনুলিখন : শিহান রিশাদ, চতুর্থ শ্রেণি]
কি ভয়ংকর ঝড়
ReplyDeleteকি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা!
ReplyDelete