নাটিকা

ফুড ফর্টিফিকেশন

মঈন উদ্দিন কোহেল

 


দৃশ্য : এক 

(স্থান : গ্রামের রাস্তা)

 

কাসেম    :    চল্ বাপ, একটু তাড়াতাড়ি হাট, তাড়াতাড়ি না পৌঁছাইতে পারলে ডাক্তার সাবরে আবার পামু না।

করিম :    আইচ্ছা।

কাসেম    :    জোরে হাটতে কি কোন কষ্ট হইতাছেরে বাপ ?

করিম     :    না, তেমুন কষ্ট হইতাছে না।

কাসেম    :    কি করুম কও, পয়সার অভাবে রিক্সাও লইতে পারতাছিনা...

মেম্বার     :    কাসেম, আরে ও কাসেম, আরে খাড়াও...

কাসেম    :    খাড়ানের সময় নাই মেম্বর সাব।

মেম্বার     :   ক্যান, কি অইছে, কিয়ের অত তাড়া তোমার ? হাডেওতো দেখলাম না তোমারে।

কাসেম    :    একডা জরুলি কামে যাইতাছি।

মেম্বার     :    আরে কিয়ের কাম, আমাকে কওয়া যায় না ?

কাসেম    :    কওয়া যাইবো না ক্যান, যাইতাছি গগণ ডাক্তারের কাছে।

মেম্বার     :    কোন গগণ ডাক্তার ?

কাসেম    :    ঐ যে আমাগো উত্তর পাড়ার গগণ ডাক্তার।

মেম্বার     :    , গগণ কবিরাজের কথা কইতাছো, হেয় আবার ডাক্তার অইছে কহন ?

কাসেম    :    হ্যারে তো অহন হগলে এই ভাবেই ডাকে।

মেম্বার     :    তাই নাকি ! তা, কার লাইগা তার কাছে যাইতাছো ?

কাসেম    :    এইযে আমার পোলা করিমরে লইয়া যাইতাছি।

মেম্বার     :    ক্যান, কি অইছে হ্যার ?

কাসেম    :    অনেক দিন ধইরা তার মুহে রুচি কইমা গেছে, তেমুন কিছুই খাইতে পারে না, না খাইতে না খাইতে দিন দিন কেমুন হুগায়া গেছে। দেহেন হ্যার শরীলে হাড্ডি ছাড়া আর কিছুই নাই। অথচ আগে কত সুন্দর আছিল পোলাডা। অনেকেই কইতাছে মাইনষের নজর লাগছে। হের লাইগা কতো কবিরাজ, বৈদ্য দেহাইলাম। ওঝা দিয়া ঝাড়-পোক করাইলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু অয় না। হেশমেশ গগণ ডাক্তারের কাছেই যাইতাছি।

মেম্বার     :    আরে হ্যায়ওতো ডাক্তার না, কবিরাজ।

কাসেম    :    কিন্তু মাইনষে কইতাছে, হ্যার অসুধ নাকি খুব ভালা...

মেম্বার     :    আরে হুন, মাইনষের কথা বিশ্বাস কইরা নিজের পোলার সর্বনাশ কইরো না।

কাসেম    :    কি কন !

মেম্বার     :    তোমার পোলার আসলেই কি অইছে, হেডি কি তুমি জানো ?

কাসেম    : হেডি জানলে কি আর অত চিন্তা করি।

মেম্বার     :    তুমি বাপ, অথচ অহনও তুমি জানো না তোমার পোলার কি অইছে। কিন্তু এতদিনে তোমার জানার দরকার আছিল।

কাসেম    :    জানার লাইগাইতো এতো জায়গায় দৌাঁড়াদৌঁড়ি করতাছি।

মেম্বার     :    ভুল জায়গায় দৌঁড়াইতাছ মিয়া।

কাসেম    :    তাইলে কি করুম ?

মেম্বার     :    আরে এতো জায়গায় না গিয়া, তোমার পোলারে ভালা ডাক্তার দেহাও।

কাসেম    :    কিন্তু ডাক্তার দেহাইতে গেলেতো ম্যালা ট্যাকা লাগে।

মেম্বার     :    আরে ট্যাকা লাগবো ক্যান, তুমি তারে নিয়া সোজা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাও। ঐ হানে ভালা ভালা ডাক্তার আছে। তারা কি কয় আগে হুইনা দেহ।

কাসেম    :    কিন্তু বিনা পয়সায় ডাক্তার দেহাইলে কি অইবো, অসুধ কিনতেওতো ম্যালা ট্যাকা লাগবো।

মেম্বার     :    সব অসুধ কিনা লাগে না, অনেকগুলা অসুধ ফিরিতেও পাওয়া যায়।

কাসেম    :    তাই নাকি।

মেম্বার     :    তাইলে আর কইতাছি কি, তুমি অহনই তারে লইয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চইলা যাও।

কাসেম    :    যাইতাছি।

মেম্বার     :    আর ঐহানে যাইয়া কোন সমস্যা অইলে আমারে জানাইও।

কাসেম    :    আইচ্ছা। আসসালামু আলাইকুম।

মেম্বার     :    ওয়ালাইকুম আচ্ছালাম।

(দৃশ্য পরিবর্তন)

 

দৃশ্য :  দুই 

(স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ডাক্তারের কক্ষ)

 

ডাক্তার    :    আপনার ছেলের বয়স কত ?

কাসেম    :    এই নয় বছর।

ডাক্তার    :    দেখে কিন্তু মনে হয় না। ওর ওজন কিন্তু একেবারে কম। একবারে হালকা-পাতলা।

কাসেম    :    হ আফা। ও এরহম আছিল না আফা। কিছুদিন আগের ও খুব মোট-তাজা আছিল। কিন্তু কিছুদিন ধইরা হুকাইতে হুকাইতে এই রহম হইয়া গেছে। আমার পোলার কি অইছে একটু কনতো ডাক্তার আফা ?

ডাক্তার    :    আসলে আপনার ছেলের সমস্যাটা মারাত্মক, সে ভয়ংকর অপুষ্টিতে ভুগছে। এর আগে ডাক্তার দেখাননি ?

কাসেম    :    না, তয় কবিরাজ দেহাইছি। গরিব মানুষ, কি করুম।

ডাক্তার    :    কবিরাজ কি বলেছে ?

কাসেম    :    কবিরাজ আর কি কইবো, খালি অসুধ দেয় আর ট্যাকা নেয়, কামের কাম কিছুই অয় না।

ডাক্তার    :    শুনুন, আমাদের দেশে বেশির ভাগই এই ভুল করে, প্রথমে ডাক্তার দেখায় না, পরামর্শ নেয় না, অসুখ যখন হাড়ে পৌঁছায় তখন ডাক্তারের কাছে দৌাঁড়ায়। তখন ডাক্তারের আর কিছুই করার থাকে না।

কাসেম    :    হায় হায় হায়, আমার পোলার কি অইছে, অসুখটাকি খুবই খারাপ, হ্যায় বাঁচবোতো ডাক্তার আফা ?

ডাক্তার    :    আরে অত ভয় পাবার কিছুই নেই। আমি কথার কথা বলছিলাম। আমার কথাটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন...

কাসেম    :    কন ডাক্তার আফা।

ডাক্তার    :    এই রকম অপুষ্টির কারনে শরীরে অনেক রকম অসুখ বাসা বাঁধে। তখন জটিল হয়ে যায় চিকিৎসা করা। তবে ধৈয্য ধরে, যতœ সহকারে কাজ করলে আপনার ছেলের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।

কাসেম    :    কি করতে হইবো একটু বুঝায়া কননা ডাক্তার আফা।

ডাক্তার    :    অপুষ্টির কারণে শরীরে রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয়, আর শরীরে রক্ত কমে গেলে খাবার গ্রহণে অনিহা দেখা দিতে পারে। তাই শিশুর জন্মের পর থেকে তাদের দিকে ভালোভাবে লক্ষ্য রাখতে হয়, খাবারের পরিমানও বাড়াতে হয়। সেই সাথে বয়স অনুযায়ী তার ওজন বাড়ছে কিনা তা লক্ষ্য রাখতে হয় এবং বয়স অনুযায়ী তার একটা তালিকাও করতে হয়। সেটা মনে হয় আপনারা করেননি।

কাসেম    :    আমরা হইলাম গিয়া গরিব-অশিক্ষিত মানুষ। এতকিছু কি আমরা জানি ডাক্তার আফা।

ডাক্তার    :    আরে এতো শুধু আপনার একার সমস্যা নয়। আমাদের দেশে অনেকেই এই ভুল করে। আর এর ফলে আমাদের দেশে অনেক শিশুই এরকম রক্ত স্বল্পতায় ভুগছে।

কাসেম    :    কি অসুধ খাওয়ামু এর লাইগা, কত দাম ?

ডাক্তার    :    শুধু ঔষধ খাওয়ালে কি আর সমস্যার সমাধান হয়, খাদ্যের মানও বাড়াতে হবে। মাছ-মাংশ খাওয়াতে হবে।

কাসেম    :    কিন্তু এতো ট্যাকা পামু কই ?

ডাক্তার    :    প্রতিদিন মাছ-মাংশ তো আমরাও খাই না। প্রতিদিন পুঁইশাক, ডাটাশাক, ধনেপাতা, বাধাকপি, তেঁতুল এসবতো খান তাই না ?

কাসেম    :    , তা খাই।

ডাক্তার    :    তার সাথে কিছু সস্তা ফল-মূল, যেমন- পেঁয়ারা, আমডা, লেবু, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা এগুলো আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে সস্তায় পাওয়া যায়, ওগুলো খাওয়াবেন আর লক্ষ্য রাখবেন ওর ওজন বাড়ছে কিনা। আর এই ওজন বাড়ছে কিনা লক্ষ্য রাখার জন্য আপনাকে একটা তালিকা তৈরী করতে হবে। এই তালিকা আপনি নিজে লিখতে না পারলে অন্য কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারবেন।

কাসেম    :    পারমু, আমার মাইয়ারে দিয়াই এই তালিকা লিখাইতে পারমু। মাশে আল্লাহ হে অহন ক্লাস সেভেনে পড়ে।

ডাক্তার    :    তাহলেতো খুব ভালো। তাকে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে আপনার ছেলের ওজনের একটা তালিকা তৈরি করতে বলবেন। সেই সাথে প্রতিদিনই তাকে বিভিন্ন রকম খাবার খেতে দিবেন, এতে তার মুখে রুচি আসবে। আর তাকে কি কি খাওয়াচ্ছেন তাও লিখে রাখবেন।

কাসেম    :    এভাবে আমার পোলা ভালা হইয়া যাইবো ?

ডাক্তার    :    আর একটা কথা, খাবারে পুষ্টিমান বাড়াতে ভিটামিন সমৃদ্ধ তেল দিয়ে খাবার রান্না করতে বলবেন। এখন বাজারে সব তেলেই ভিটামিন রয়েছে।

কাসেম    :    এ তেলের দাম কত ?

ডাক্তার    :    একই দাম। বাজারে যে তেল রয়েছে সে তেলে ভিটামিন মিশালে তবে প্রতি পাঁচ লিটারে এ তেলের দাম বাড়বে মাত্র পাঁচ টাকা। কাজেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তার তেমন কোন কারণ নেই।

কাসেম    :    এই তেল দিয়া রান্না করলে আমার পোলা ভালা হইয়া যাইবো, তাই না আফা।

ডাক্তার    :    আশা করছি সেরে যাবে। তবে মনে রাখবেন, প্রতিদিনই খাবারের পরিমান বাড়াতে হবে। আর আগেই বলেছি, নিয়মিত ওজন নিতে হবে। ওজন যদি বাড়তে থাকে, তাহলে দুশ্চিন্তা করার কোন কারণ নেই। এরপরও কোন সমস্যা মনে হলে ডাক্তার দেখাবেন, কবিরাজ নয়। ঠিক আছে ?

কাসেম    :    ঠিক আছে মানে, এক্কেবারে ঠিক আছে। আর ভুল হইবো না ডাক্তার আফা।

 

(সমাপ্ত)


Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা