বোকা শৈশব

'পাঠশালা বানান করো দেখি'

হারুন রশীদ



ঘরে বসেই প্রথম শ্রেণী আর দ্বিতীয় শ্রেণীর সব বই পড়া শেষ হলেও তখনো স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি আমাকে। গ্রাম থেকে শহরে এসেছি অল্প কয়েকদিন আগে। শহরের স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য বাবা কলোনীর স্কুলে নিয়ে গেছে। সাথে উৎসাহ নিয়ে গেছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া মামাতো ভাই বাদল। ওরা আগ থেকেই কলোনীর বাসিন্দা। কথা ছিল দুজনে একসাথে আসা যাওয়া করবো। 


স্থান আগ্রাবাদ সরকারী প্রাইমারী স্কুল। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসের এক সকালবেলা। বার্ষিক পরীক্ষার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকী। হেডস্যারের সামনে বসে বাবা বললেন, “স্যার, আমার ছেলে ক্লাস ওয়ান-টু দুটোর পড়াই শেষ করে ফেলেছে। ও সব পারে”। 


মামাতো ভাইও সায় দিল, “হ্যাঁ স্যার, ও সব পারে”। 


বাবা বললেন, “তবে সে একটু ভীতু। একা একা ক্লাসে বসতে চাইছে না। তাই বাদলের সাথে বসে ক্লাস করার সুবিধার্থে সরাসরি ক্লাস টুতে ভর্তি করে নেয়া যায় কিনা।” 


হেডস্যার বললেন, “সবকিছু পারে? বাহ বাহ। খুব ভালো, খুব ভালো। আচ্ছা ঠিকাছে সরাসরি ক্লাস টু-তেই ভর্তি করিয়ে নেবো। শুধু ছোট্ট একটা প্রশ্ন করি। দেখি খোকা ‘পাঠশালা’ বানান করো তো?”


আমার জীবনে সেই প্রথম কোন স্কুলের আঙ্গিনায় পা দেয়া। স্কুল একটা আতঙ্কের বিষয় আমার কাছে। কোন কারণে মনে মনে ধারণা হয়েছিল স্কুল হলো এমন একটা জায়গা যেখানে বড় বড় বেত নিয়ে মাস্টার নামের দৈত্যরা ঘুরে বেড়ায়। কোন ছেলেপেলে সামনে পড়লে হালুম করে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। পিটিয়ে লাল করে দেয় পিঠের চামড়া। 


ইন্টারভিউর জন্য হেডস্যারের রুমে ঢোকার সাথে সাথে পেটের ভেতর হাত পা সেঁদিয়ে গিয়েছিল। হেডস্যারের প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে মনে হলো শরীরের বাকী অংশও গায়েব হয়ে গেছে। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। একটা অক্ষরও না। অথচ আমি জানি পাঠশালার চেয়ে অনেক কঠিন বানানও আমার কাছে ছেলেখেলা।


হেডস্যার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ওকে ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি হতে হবে।”


বাবার বড় মুখটা ছোট হয়ে গেল এই কথা শুনে। প্রথম শ্রেণীতেই ভর্তি করাতে বাধ্য হলেন আমাকে। তবে হেডস্যার বললেন, ভয় না কাটা পর্যন্ত সে পাশের ঘরে ক্লাস টু-তে বাদলের সাথে বসতে পারবে। 


ভয় কাটাতে আমার দুবছর লেগে গিয়েছিল প্রায়। ক্লাস থ্রির অর্ধেক পর্যন্ত বাদলের সাথেই ক্লাস করেছিলাম। 

তবে ভয় কাটার পর স্কুলে গিয়ে যেসব কাণ্ড করেছি সেই কাহিনীও কম যায় না। সেগুলো পরের পর্বের জন্য থাকুক।

Comments

Popular posts from this blog

ভিনদেশী রূপকথা

আতনিন বিন জহির

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা