অনিন্দিতা গোস্বামীর ধারাবাহিক উপন্যাস


অবাক পৃথিবী




পর্ব- আট

(পূর্ব পাঠের পর)



গোবিন্দ দাদু সবার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ফের হাঁটা লাগাতে লাগাতে বললেন, দেশে, বাংলাদেশে,আমার দেশে।এখন তো শুনছি আর কোনো আলাদা আলাদা দেশ থাকবে না,তবে ঐ হতচ্ছাড়া কাঁটা তারের বেড়াটাও আর নিশ্চয়ই থাকবে না।আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব ওদেশে। আরে রে রে রে,রোরোর বাবা দৌড়ে গিয়ে চেপে ধরল গোবিন্দ দাদুর হাত।গোবিন্দদাদু ফের কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলেন,নিজের দেশে যাব তা-ও আবার পাসপোর্ট। কতবার বিনয়কে বলেছি আমার একটা পাসপোর্ট করে দে,তা বিনয়ের সময়ই হয় না।সে ব্যস্ত মানুষ। তার ওপরে সে পাসপোর্ট করা নাকি খুব ঝামেলা। ভোর চারটে থেকে পাসপোর্ট অপিসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় লম্বা লাইনে।

রোরোর বাবা হাত দিল গোবিন্দদাদুর পিঠে,বলল,সে কী হলে কী হবে সে তো অনেক পরের কথা জেঠু।এখনো তো কিছুই হয় নি,এখনও তো সবকিছুই বহাল আছে আগের মতোই।সেই কাঁটাতার,সেই রক্ষীও।আর সত্যিই যদি একদিন সব দেশ মহাদেশগুলো জুড়ে যায় আর তারপরেও যদি আমরা বেঁচে থাকি তবে শুধু আপনি কেন অনেকেই তো আমরা যাব ঐ দেশে।ওদেশে যাবার ইচ্ছা আমারও তো কম নয়।শুধু বাপ ঠাকুরদার ভিঁটে বলে তো নয়,সেই যৌবন থেকে, যবে থেকে কবিতা পড়তে শুরু করেছি তবে থেকে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে সন্ধে নামা দেখবার শখ।

বাবার কথায় খুক্ করে হেসে ফেলল রোরো,বাবার এই কবিতা বাতিকের জন্য কমতো পিছনে লাগে না তার মা।হয়তো প্রচন্ড একটা উদ্বেগের মুহূর্ত কিংবা রাগের, বাবা দুম করে একটা কবিতার লাইন আউড়ে বসবে। ব্যাস মা অমনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। এই যেমন মা যখন বাড়ি ছেড়ে মাঠে নেমে আসার সময় দ্রুত হাতে জিনিসপত্র গুছোচ্ছে ব্যাগের মধ্যে,বাবা হাত-পা নাড়িয়ে গলা কাঁপিয়ে বলতে লাগল, থরথর করে কাঁপিছে ভূধর / শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে।

সে যাক কিন্তু রোরো ভাবছিল অন্য কথা, আচ্ছা যদি সব দেশ এসে সত্যিই জুড়ে যায়, সারা পৃথিবী জুড়ে হয়ে যায় একটিই দেশ, তবে তো সে বেশ হেঁটে হেঁটেই চলে যেতে পারে জ্যাকলিনের দেশে। কেমন আছে এখন জ্যাকলিন, ঠিক আছে তো? ওদের দেশটাও কি এমনই চলছে রোরোর দেশের মতোই? হ্যাঁ, হ্যাঁ তাইতো বললো রেডিওতে, পৃথিবীর সব দেশ এখন চলছে। ওর বাবা প্রেসিডেন্ট, ওদের নিশ্চয়ই এমন কথাও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে যেখানে বিপদের কোন ভয় নেই।

 পর্ব নয়

প্রথম চড়টা খেলেন প্রতাপ সরকার। এটা মোটেই কারোর কাছে কাম্য ছিল না।প্রতাপ সরকার এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এমনকি পরের ইলেকশনে সম্ভাব্য চেয়ারম্যান। কোনো দল বলে নয় প্রতাপ সরকারকে ভালোবাসে কম বেশি সকলেই। ছোটরা তো বটেই এমনকি বড়রাও।পুজোর সময় হৈ হৈ করে সবাইকে জমিয়ে রাখেন তিনি।কুইজ,গান,কবিতা। তবে সম্প্রতি একটু বেশি পরিমানে কাজের চাপ ঘাড়ে এসে পড়ায় সত্তর ঊর্ধ্ব প্রতাপ সরকার খানিক ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছেন।পার্টির কাজে বড্ড বেশি ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তাকে। এহেন প্রতাপ সরকার পুরসভার কিছু লোকজন নিয়ে এসে বললেন, মাঠের চারপাশে যে সব বড় বড় গাছ আছে আমি কেটে দেবো মনস্থ করেছি। বলা যায় না যা পরিস্থিতি, মাটির এই কাঁপন গাছগুলো কতক্ষণ নিতে পারবে, যদি উল্টে কারো ঘাড়ে পড়ে সেক্ষেত্রে বিপদ বাড়বে। আপদকালীন পরিস্থিতিতে রিস্ক না নেওয়াই ভালো।

রোরোর মা বলে প্রতাপদার দোষের মধ্যে একটাই দোষ, প্রচারের সুযোগটা তিনি কোনো বিপদের মুহূর্তেও হাতছাড়া করতে পারেন না।তা এদিনও প্রতাপ সরকার ওরফে ছোটদের সকলের প্রিয় প্রতাপ জেঠু ফটোগ্রাফারকে হেঁকে বললেন, শোনো হে ছবিটা ঠিক করে তুলো, তোমাদের জন্য শেষ পর্যন্ত আমাকেও কুড়ুল ধরতে হলো। বলে গাছের গায়ে প্রথম ঘা-টা তিনিই দিলেন, আর ব্যাস যা হবার তাই হল,নিচের একটা ডাল সাঁই করে এসে ঠাস করে যেন চড় লাগিয়ে দিলো প্রতাপ সরকারের গালে।কুড়ুল ফেলে ভূত, ভূত বলে তিনি ছুট লাগালেন পাই পাই করে। পুরসভার কোন কর্মীই আর হাত লাগাতে সাহস পেলো না গাছেদের গায়ে।পাড়ার ইয়ং ছেলেরা অবশ্য মুখ টিপে টিপে হেসে বলল, প্রতাপ জেঠুর নাটক দেখলি! কিন্তু রোরোর কেমন যেন একটা অদ্ভুত চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল মাথার মধ্যে। এসব কী যে হচ্ছে চারপাশে ক'দিন ধরে! সে চুপি চুপি গিয়ে প্রতাপ জেঠুর পাঞ্জাবির কোণা টেনে ধরে বললো, আরেকবার একটা অন্য গাছের ট্রাই করো না জেঠু। তুমি না-হয় না -ই কুড়ল ধরলে, ওরাই ধরুক।

প্রতাপ সরকার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, এ ছেলের মতলব কী? বললেন, কেন বলতো?

রোরো বলল,না দেখতাম ওটা কাকতালীয় দুর্ঘটনা নাকি সত্যি কিছু একটা ঘটল!

প্রতাপ সরকার রোরোর পিঠে চাপড় মেরে বললেন, বলছো? বেশ তবে না হয় অর্ডার দিচ্ছি আর একবার।

লোকজন কুড়ুল নিয়ে ফের এগোল অন্য একটা গাছের দিকে।এবার রোরোও তাদের পিছু নিল।সে একেবারে কাছ থেকে দেখতে চায় ব্যাপারটা। আবারও সেই একই ঘটনা।একটা ডাল নিচু হয়ে এসে ঠাঁই করে বাড়ি মারল একজনের পিঠে। এবার সব লোকজন হাঁউমাউ করে দৌড় দিল কুড়ুল ছেড়ে। খানিক ভ্যাবলার মতো হয়ে গেল রোরো। এমন সময় পুরসভা থেকে মাইক ফুঁকে রিক্সা চলে গেল এক আজব খবর দিয়ে, বন্ধুগণ মধুপুর গ্রামে ঘটে গেছে এক অদ্ভুত ঘটনা, সেখানে কিছু ক্ষেত্ এলাকায় সঠিক জল নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় ধান গাছের গোড়ায় অধিক জল জমে ফসল নষ্ট হচ্ছিল অনেক দিন ধরে,আজ সকালে দেখা যায় ধান গাছ গুলো হাঁটতে-হাঁটতে পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির সামনে এসে মাথা দুলোচ্ছে।তাতে ভয় পেয়ে গ্রামের মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্রাম ছেড়ে আমাদের শহরের দিকে আশ্রয় নেবার জন্য ছুটে আসছেন।বিপদের দিনে কেউ তাদের ভুল বুঝবেন না, বিপদের দিনে বন্ধুর মতো হাত বাড়িয়ে তাদের আশ্রয় দিন। তবে আপনারা ভয় পাবেন না,মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যেহেতু সর্বক্ষণ আমাদের মধ্যে একটা চলন অনুভূত হচ্ছে তাই এখন বিভিন্ন ধরনের ইলুউশন বা দৃষ্টি বিভ্রম তৈরি হতে পারে।

বীরপুরের প্রোমোটার মোহন সিংহ বসেছিলেন মাঠের মাঝখানে। হঠাৎ তিনি ছটফট করে উঠলেন, বললেন, পাছায় সূচের মত কি যেন ফুটছে। বলতে বলতেই তিনি কেমন যেন বিভ্রান্তের মত দৌড়তে আরম্ভ করলেন। রোরোর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য, মোহন সিংহ দৌড়চ্ছেন, মোটা ভুঁড়ি নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়াচ্ছেন, তার দু'পায়ের মাঝখান দিয়ে ঝুলে আছে পাজামার লম্বা দড়ি।হোঁচট খেতে খেতে দৌড়চ্ছেন তিনি, আর তার পিছু পিছু তাকে তাড়া করে দৌড়চ্ছে হাজার খানেক শাল আর সেগুনের গাছ। বীরপুরের দক্ষিনে ছিল এক মস্ত জঙ্গলমহল আর একটা লম্বা ঝিল। শীতকালে কত পাখি আসত তাতে।সেই এলাকার গাছ কেটে মোহনসিংহ গড়েছেন একশ ফ্ল্যাটবাড়ি। বদ্রি পাখি খাঁচায় পুরে ঝুলিয়েছেন নিজের বাড়ির বারান্দায়। সেই মোহন সিংহ দৌড়চ্ছেন তাড়া খেয়ে। পৃথিবীটা কি তবে সুন্দর হচ্ছে ধীরে ধীরে? গুড়গুড় করে রোরোর কেমন যেন আনন্দ হলো ভেতরে ভেতরে৷



(পরের অংশ আগামী সংখ্যায়)



No comments:

Post a Comment