সোনিয়া কবিরের গল্প


 বনভোজন



পোড়াদহ স্টেশনের প্লাটফর্মের কোল ঘেঁষে একদল কাশফুল হেসে আছে।শরতের আকাশে এক চিলতে মেঘের আনাগোনা চলছে। যে কোন সময় এই মেঘ বৃষ্টি রূপে কাশফুলের হাসিটা ম্লান করে দিয়ে যাবে। কাশফুলেরা দুমড়ে মুচড়ে যাবে। যেমন এতদিনের আনন্দ শেষে বন্ধুদের ছেড়ে যেতে খিজিরের মনটা বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ঢাকাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস মৃদু পায়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে। ট্রেনের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে খিজির মলিন মুখে হাত নেড়ে ফারান,জায়ান এবং তুরানকে বিদায় জানাচ্ছে। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তারাও অশ্রুসিক্ত নয়নে হাত নেড়ে খিজিরদের বিদায় জানাচ্ছে। ওরা ওদের বাবাদের সঙ্গে এসেছে নতুন বন্ধুকে বিদায় জানাতে। আস্তে আস্তে ট্রেনের গতি বেড়ে গেল তারাও একে অপরের কাছে অস্পষ্ট হতে লাগলো। এবার আমরা জানব খিজির, তুরান এবং ফারানের বন্ধু হওয়ার গল্পটা।
 
রমজানের ঈদের চার-পাঁচ দিন আগে বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে বাড়িতে এসেছে খিজির। দাদাজান মারা যাবার পর বাড়ি আসতে ভালো লাগে না তার। তিনি বেঁচে থাকতে মাদ্রাসা ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে গেলে দিনগুলো বেশ ভালোই কাটত। রোজ ভোরে ফজরের নামাজের পর আলো ফুটতেই দাদাজানের সাথে মোড়ের দোকানে গিয়ে দুধ চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেত। এই ব্যাপারটা খিজিরের বেশ ভাল লাগতো। কারণ তাদের দাদা নাতির চুপিচুপি দুধ চা খেতে যাওয়ার বিষয়টা তার বাবা-মা কেউই জানত না। প্রথমদিকে তো দাদিজানও জানত না।
জানলে তো এই মজাটা বন্ধ হয়ে যেত। কারণ দাদাজানের ডায়বেটিকস ছিল।
তবে চার পাঁচ দিন পর মায়ের হাতে ধরা খেয়েছিল দাদা নাতি।
 
বছর দুয়েক হল সে দাদাজানকে হারিয়েছে। তাকে ছাড়া এ বাড়িতে দমবন্ধ লাগে খিজিরের। বাড়ির আশেপাশে ফারান ছাড়া তার সমবয়সী আর কোন ছেলে নেই। ওর সাথে প্রথম প্রথম বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিল খিজির। কিন্তু ফারান যেন কেমন! একটু গোমড়া স্বভাবের কারো সাথে তেমন একটা মিশে না। স্কুল প্রাইভেট শেষ করে মোবাইল নয়তো ল্যাপটপ নিয়ে বসে অথবা টিভিতে কার্টুন দেখে। বাড়ির সামনের খেলার মাঠে যখন বড় ভাইয়ারা ক্রিকেট খেলতে আসে খিজির সহ তখন আশেপাশের সব ছেলে-মেয়েরা মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে খেলা দেখে। তখন ফারানকে কখনো সখনো বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কিন্তু মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে কখনোই খেলা দেখে না সে । এলাকায় ওর কোন বন্ধু নেই। তাই অনেক চেষ্টা করেও ফারানের সাথে খিজিরের বন্ধুত্বটা হয়ে ওঠেনি। এদিকে কাজিনরা তার থেকে অনেক ছোট তাই বাড়িতে তার খুব বেশি বোরিং লাগে।
 
ঈদের দুই দিন আগে খিজির বাবাকে বলল ' বাবা আমার কিছু ভাল লাগছে না। গ্রামের ঈদে কোন আনন্দ নেই। সাব্বিরের কত ফ্রেন্ড আছে। কিন্তু আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই। '
 
খিজিরের বাবা ছেলেকে বনভোজন করার আইডিয়া দিলেন। আইডিয়াটা খিজিরের তেমন পছন্দ হল না । তারপরও সে চিন্তা করল বসে বসে বোরিং হওয়ার চেয়ে কিছু একটা তো করা ভাল।
 
বাবা যে ভাবে শিখিয়ে দিয়েছেন, চাঁদ রাতের আগের দিন সকালবেলা খিজির তার ছোট ভাই সাব্বিরকে নিয়ে আশে পাশের বাড়িতে গিয়ে সেভাবে তার বয়সী এবং ছোটদের সবাইকে বনভোজনের কথা বলল। যারা বনভোজন করতে আগ্রহী সবাইকে বিকেলে তাদের বাড়িতে আসতে বলল। ফেরার পথে খিজির তার ভাইকে নিয়ে ফারানদের বাড়িতে গেল। ফারান সব শুনে ওদের দুই ভাইকে মুখ ভেংচি কেটে বলল ' এ্যাহ রাজধানী শহর থেকে গ্রামে এসে বনভোজন খেলবে! ল্যাদা বাচ্চা। আবার আসছে আমি খেলব কিনা এটা জানতে! আমি এসব আনস্মার্ট খেলা খেলি না। আমি খেলি শ্যাডো ফাইট, সাব বয়, হ্যারিকেন সুপার হিরো। '
 
ফারানের কথায় অপমানিত হয়ে, কথা না বাড়িয়ে খিজির তার ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরল। বাসায় এসে খিজির বাবাকে বলল সে কিছুতেই বনভোজন করবে না। ফারান তাকে অপমান করেছে। তাছাড়া ও যা বলেছে তা খিজিরের কাছে ঠিক মনে হয়েছে। বাবা ওকে বুঝিয়ে বলল,ফারান যা বলেছে তা ভুল বলেছে। বনভোজন করতে বয়স লাগে না। আর বনভোজনের জন্য ওদের বয়সটাই উপযুক্ত বেশি। তাছাড়া এমন আয়োজনে আশেপাশের সবার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন হয়।ফারান আসবে না তো কী হয়েছে! বাকি সবাইকে নিয়ে সুন্দর করে একটা বনভোজনের আয়োজন করতে বললেন তিনি। 
বিকেলে আশেপাশের সব ছেলেমেয়েরা চলে এলো। তাদের দেখে খিজিরের মন ভাল হয়ে গেল। নিচতলার ঘরের খোলা বারান্দায় সবাইকে নিয়ে বসে সে বনভোজন সম্পর্কে বৈঠক করল। বৈঠকে তারা মাথাপিছু চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করল। এছাড়াও কী কী আইটেম রান্না করবে, কারা বাজার করবে, তাদের রান্নায় সাহায্য করবে কারা এসব ঠিক করল। সবাই মিলে আলোচনা করতে খিজির বেশ আনন্দ পাচ্ছে। মা ওদের জন্য পাকোড়া ভেজে নিয়ে এলেন। সেই সাথে বেশি করে চানাচুর দিয়ে ঝাল মুড়ি মাখিয়ে নিয়ে এলেন। বাবা দোকান থেকে মেরিন্ডা কিনে দিলেন। সব কিছু মিলিয়ে একটা পার্টির আমেজ পেল ওরা সবাই। এত আনন্দঘন পরিবেশে খিজিরের বার বার ফারানের কথা মনে পড়ল। ইশ ফারান যদি আসত। তাহলে ষোলকলা পূর্ণ হত।
 
রাতের বেলা সে বাবাকে জানাল বনভোজনকে ঘিরে তার ভীষণ আনন্দ কাজ করছে ভিতরে। সবচেয়ে খুশির বিষয় হচ্ছে বনভোজন করতে গিয়ে সে তার চেয়ে অল্প ছোট বয়সের দুইজন বন্ধু পেয়ে গিয়েছে। এখন আর তার দাদা বাড়ি আসলে বোরিং লাগবে না। সেই সাথে সে ফারানকে মিস করার কথাটাও বলল। বাবা তাকে একটা আশার কথা শোনালেন, ফারান হয়ত সব আয়োজন দেখে শেষের দিকে এসে উপস্থিত হবে।
 
ফজরের নামাজের পর খিজিরের ঘুম হয়নি আর। সে বিছানা ছেড়ে গিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে। মা বলেছেন, সকালের বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। তিনি আরো বলেছেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে সবুজ গাছপালার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে। এতে করে চোখের জ্যোতি ভালো থাকে। বাগানে রংবেরঙের পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা গেল। ভোরের তিরতিরে হাওয়াটা গায়ে লাগতেই দাদাজানের কথা মনে পড়ে গেল খিজিরের। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে ওদের বনভোজনটা আরো মজার হত। সে মনে মনে দাদাজানের জন্য দোয়া করল।
 
সকাল নয়টা বাজতেই সবাই চাঁদা নিয়ে এসে হাজির হল। সবার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত খুশির ঝলক। খিজির একটা ডাইরি নিয়ে এসে সবার চাঁদার পরিমাণ লিখছে। এমন সময় ওদের বাড়ির গেটে মৃদু একটা শব্দ হল। সবাই তাকিয়ে দেখে গেটের আড়ালে ফারান। ধরা পড়ার পর ফারান আবারো মুখ ভেংচি কেটে বলল-আনস্মার্টের দল। এই বলে সে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল। জায়ান এবং তুরান ক্ষেপে দৌড়ে ফারানের দিকে যাচ্ছিল। খিজির ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল ' কেউ খারাপ কাজ করলে বা খারাপ ব্যবহার করলে তাকে সেটা ফেরত দিতে হয় না বরং তার সাথে ভালো ব্যবহার করে বুঝিয়ে দিতে হয়। আর এটাই আমাদের প্রিয় নবীজীর শিক্ষা।' সত্যি বলতে গেলে খিজিরেরও অনেক খারাপ লেগেছে গায়ে পড়ে এসে ফারানের এমন আচরণ। তবে আজ ওর মনে হল ফারান বনভোজনে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছে। আগ্রহ না থাকলে এভাবে গেটের আড়ালে লুকিয়ে ওদের কথা শুনতো না। ও এমন টাইপের ছেলে না অন্তত এতোটুকু এতদিনে বুঝে গেছে খিজির।
 
বনভোজনের দিন সকাল বেলা থেকেই খিজির জায়ান আর তুরান মিলে এলাকার দোকান থেকে সদাইপাতি করে নিয়ে আসল। মায়ের সাহায্য নিয়ে খিজির আগেই সদাইপাতির লিস্ট করে রেখেছিল। এর আগে ওরা কখনোই এ সমস্ত জিনিস কিনেনি। তাই এদের ভিতর অন্যরকম একটা মজা কাজ করছে। সেই সাথে হুলুস্থুল বেঁধে গেল। এটা আনে তো ওটা আনতে মনে থাকে না।
 
দুপুর বেলা সবাই যখন ভাতঘুমে ব্যস্ত। ওরা সবাই মিলে খোলা বারান্দায় পেঁয়াজ রসুনের খোসা ছাড়াতে বসলো। পেঁয়াজ নিয়ে এলাহি কাণ্ড ঘটে গেল! একটা পেঁয়াজের মুখ ছুড়ি দিয়ে কেটে খিজির খোসা ছাড়াতে গেলে সবার চোখ থেকে টসটস টসটস করে জল পড়তে লাগল। পাশে বসেই খিজিরের ছোট দাদী পান খাচ্ছিলেন। ওদের এমন অবস্থা দেখে তিনি এসে পেঁয়াজ রসুন ছিলতে বসলেন। খিজির অবশ্য দিতে চায়নি কারণ বাবা বলেছে বনভোজনের সব কাজ নিজের হাতে করলে বেশি আনন্দ লাগে।
 
খিজিরদের ছাদ থেকে ফারানদের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। সে ছোট দাদীর সুপারি আনতে ছাদে গেল। রোদে দেয়া সুপারি তোলার সময় ঐদিক নজর পড়তেই খিজির দেখে, ফারান বারান্দার গ্রীলে থুতনী লাগিয়ে একভাবে সবার পেঁয়াজ রসুন ছিলা দেখছে। এই দৃশ্য দেখে ওর মন বলছে ফারানকে গিয়ে নিয়ে আসতে। ফারান যদি আবার অপমান করে এই ভয়ও কাজ করছে।

সন্ধ্যের আগে খিজিরের বাবা এসে সিলিন্ডার গ্যাসের চুলাটা ওদের খোলা বারান্দায় সেট করে দিল। ওর চাচিমা মুরগি কেটে দিল। এভাবেই বড়রা সবাই বনভোজনের কাজে ওদের হেল্প করতে শুরু করে। সব যোগার হতেই চুলায় খিঁচুড়ি চড়িয়ে দেয়া হল। মাগরিবের নামাজ শেষে জায়ান তুরানের আম্মু সহ বনভোজনে অংশগ্রহণকারী সকল ছেলে মেয়েদের মায়েরা এসে হাজির হল। চমৎকার একটা আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হলো খিজিরদের বাড়িতে। সবাই খিজিরকে ধন্যবাদ দিল এত সুন্দর একটা আয়োজন করার জন্য।
 
রান্না শেষ সব ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে প্লেট গ্লাস নিয়ে এলো। খিজিরের আম্মু সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। বড় পাটি বিছিয়ে সবাই খেতে বসল। এরই মাঝে খিজিরকে হঠাৎ করে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে খিজিরকে কেউই দেখতে পায়নি। সবাই প্রথমে ভাবলো হয়তো কোল্ডড্রিংকস আনতে দোকানে গিয়েছে। তুরান আর জায়ান দোকানের ওদিকে গিয়ে খবর নিয়ে এলো ওদিকে সে যায়নি। এভাবে সবার উৎকণ্ঠা যখন বেড়ে চলছিল, এমনি সময় খিজির ফারানের হাত ধরে হাসতে হাসতে গেট পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল।
 
খিজিরের বাবা দুজনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে সাব্বাশ বলে বুকে টেনে নিলেন। তিনি চাইতেন ফারানের সাথে ছেলের একটা ভালো বন্ধুত্ব হোক। আর সেই সূত্র ধরে ফারান এলাকার ছেলে মেয়েদের সাথে মিশে সুস্থ মানসিকতায় প্রকৃতির আলো বাতাসে বেড়ে উঠুক।


বনভোজনের পরে যে কয়দিন খিজির বাড়িতে ছিল সে দিনগুলো মহা আনন্দে কেটেছে তার।


ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক করে। খিজিরের মন খারাপ দেখে সাব্বির অবিকল বড়দের মত করে বলল ' কয়দিন পরে তো আবার ছুটি পাবে তখন আমরা আবার বাড়ি এসে বেড়িয়ে যাব। এটার জন্য এমন গোমড়া মুখ করে বসে থাকতে হয়! এখন ট্রেন জার্নিটা একটু উপভোগ কর। যখন যেমন পরিস্থিতি সেটা মেনে নিতে হয় '
ছোট ভাইয়ের পন্ডিতি স্টাইল দেখে বাবা-মা এবং খিজির হেসে দিল।

No comments:

Post a Comment